ডায়ার উলফ থেকে ডি-এক্সটিংশন:
বিলুপ্ত প্রজাতি পুনরুজ্জীবনের বিজ্ঞান ও নৈতিকতা
ভূমিকা
আমাদের আল্লাহর সৃষ্টির বিস্তৃতি ও অদ্ভুত নন্দনায়নের সাক্ষী হিসেবে প্রাণী জগতের অসংখ্য রূপ আছে। কিন্তু মানব ইতিহাসে এক সময় এমন ছিল যখন কিছু প্রাণী বিলুপ্তির মুখোমুখি হয়েছিল। বিলুপ্ত প্রজাতিকে পুনরুজ্জীবিত করার ধারণা, বা ডি-এক্সটিংশন, আজ বিজ্ঞান জগতের অন্যতম আকর্ষণীয় এবং বিতর্কিত বিষয়গুলোর একটি। এই আর্টিকেলে আমরা ডায়ার উলফের (Dire Wolf) উদাহরণ তুলে ধরবো, যাকে নানান সৃজনশীল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আধুনিক যুগে ফিরিয়ে আনা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, এবং এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞান, নৈতিকতা ও পরিবেশের সঠিক ভারসাম্যের আলোচনা করবো।
বিজ্ঞান ফ্যাক্ট
ডায়ার উলফের DNA 13,000 বছর পরেও সংরক্ষিত পাওয়া গেছে! Colossal Biosciences 2025 সালের মধ্যে প্রথম হাইব্রিড তৈরি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
বিলুপ্ত প্রজাতি ও ডি-এক্সটিংশন: এক পরিচিতি
বিলুপ্ত প্রজাতির পুনর্জীবিত করার ধারণাটি শত শত বছর ধরে মানব মনের কল্পনাকে মুগ্ধ করেছে। বিজ্ঞানের এই নতুন দিগন্তে তিনটি প্রধান প্রযুক্তিগত পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে:
▣ ব্যাক ব্রিডিং
এই প্রক্রিয়ায় বর্তমান জীবজগতের মাঝে থেকে এমন প্রজাতিকে বেছে নেওয়া হয়, যার মধ্যে বিলুপ্ত প্রজাতির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বংশবিস্তার বাড়িয়ে ঐ বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করা হয়। কোয়াগা প্রজেক্ট (Quagga Project) এই প্রক্রিয়ার একটি উদাহরণ, যেখানে কয়েক প্রজন্ম পর এমন কিছু প্রাণী জন্ম নেয় যারা দেখতে পূর্বের প্রজাতির অনুরূপ হয়ে ওঠে [উৎস: BBC News, 2019]।
▣ ক্লোনিং
ক্লোনিং হচ্ছে সঠিক জেনেটিক তথ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে কোনো বিলুপ্ত প্রাণীর সঠিক কপি তৈরি করার চেষ্টা। ১৯৯৬ সালে ডলি নামের ভেড়া এই পদ্ধতির মাধ্যমে ক্লোন করা হয়েছিল, যা বিজ্ঞান জগতে এক নতুন প্রান্তরেখা স্থাপন করেছিল [উৎস: Nature, 1996]। তবে ডি-এক্সটিংশনের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বহু প্রজাতির জন্য কার্যকর প্রমাণিত হয়নি, যেমন স্প্যানিশ বকরির ক্ষেত্রে দেখা গেছে [উৎস: Colossal Biosciences, 2000]।
▣ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং
আধুনিক প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর দিক হল CRISPR ক্যাসনারাইন প্রযুক্তি। এই প্রক্রিয়ায় বিলুপ্ত প্রাণীর জীবাশ্ম থেকে সংগ্রহ করা ক্ষতিগ্রস্ত DNA পুনরায় সম্পাদনা করে আধুনিক প্রজাতির সাথে মিলিয়ে একটি নতুন জীবনের সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়। এই পদ্ধতি বিজ্ঞানীদের কাছে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বলে বিবেচিত, কারণ এটি তাত্ত্বিকভাবে প্রজাতির সঠিক বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনার সুযোগ করে দেয় [উৎস: Doudna & Charpentier, 2020]।
“প্রতিটি বিলুপ্তি হলো একটি লাইব্রেরি পোড়ানো”
– ড. বেথ শাপিরো, ডি-এক্সটিংশন গবেষক
ডায়ার উলফ: ইতিহাস, বিলুপ্তি ও পুনর্জন্মের কাহিনী
ইতিহাস ও প্রাথমিক বিবরণ
ডায়ার উলফ, বা Canis dirus, এক সময় উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিরাজ করতো। ১৮৫৮ সালে প্রথম এই প্রাণীর জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়, এবং সেই সময়ই বিজ্ঞানী জোসেফ লিডি এটির বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেন—”ভয়ংকর কুকুর” অর্থাৎ ডায়ার উলফ [উৎস: Leidy, 1858]। পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে, একজন বিজ্ঞানী এই প্রাণীটিকে গ্রে উলফ ও অন্যান্য আধুনিক নেকড়েদের থেকে আলাদা বলে দাবি করেন, যদিও সেই সময়ের বিজ্ঞানক দৃষ্টিভঙ্গি একে গ্রহণ করতে অনেক সময় লেগেছিল।
বিলুপ্তির কারণ
প্রায় ১৩,০০০ বছর আগে, মানব সভ্যতার উন্নতি, আবহাওয়ার পরিবর্তন ও পরিবেশগত অস্থিরতার ফলে ডায়ার উলফ বিলুপ্ত হয়ে যায়। দুইটি প্রধান থিওরি ছিল –
- শিকার ও খাদ্যের অভাব: ডায়ার উলফ বৃহৎ শরীরের কারণে বড় প্রাণীদের শিকার করতো। কিন্তু জনসংখ্যা হ্রাস ও খাদ্যশ্রেণীর কমতির কারণে শেষ পর্যন্ত বিলুপ্তি ঘটেছিল।
- জেনেটিক অনুপযোগিতা: গ্রে উলফদের সাথে মিল না থাকায়, ডায়ার উলফেরা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছিল [উৎস: Nature Journal, 2021]।
পুনর্জন্মের প্রচেষ্টা ও Colossal Biosciences
২০২১ সালে বিজ্ঞান জগতের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় যখন বিলিয়নেয়ার বেন ল্যাম এবং বিজ্ঞানী জর্জ চার্চ মিলিত হয়ে Colossal Biosciences নামক একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো বিলুপ্ত প্রাণীদের পুনর্জন্ম। এই কোম্পানির প্রথম প্রজেক্ট হিসেবে তারা ডায়ার উলফ পুনর্জীবিত করার প্রচেষ্টা শুরু করে, যার মাধ্যমে তাদের আশাবাদ ছিল – বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে মানব সভ্যতার একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হবে [উৎস: Colossal Biosciences, 2023]।
ডি-এক্সটিংশনের প্রক্রিয়াগত দিকসমূহ
১. ব্যাক ব্রিডিংয়ের সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া
ব্যাক ব্রিডিং পদ্ধতির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা প্রথমে বেছে নিয়েছেন এমন আধুনিক প্রজাতিকে, যার মধ্যে বিলুপ্ত প্রজাতির সামান্য বৈশিষ্ট্য ছিল। ধীরে ধীরে বংশবিস্তার ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে বৈশিষ্ট্যগুলোকে জেনেটিক কোডে ফিরিয়ে আনা হয়। এই পদ্ধতি, যদিও সফল হলেও, প্রায়ই সমগ্র প্রজাতির স্বাভাবিক জিনগত বৈচিত্র্যের কিছু অংশ হারিয়ে ফেলে, যা এক নৈতিক ও পরিবেশগত প্রশ্ন তুলতে পারে [উৎস: BBC News, 2019]।
২. ক্লোনিং ও এর জটিলতা
ক্লোনিং প্রযুক্তিতে মৃত জীবের কোষ থেকে নিউক্লিয়াস পৃথক করে আধুনিক প্রজাতির ডিমে সন্নিবেশ করানো হয়। যদিও এই পদ্ধতি তাত্ত্বিকভাবে সঠিক কপি তৈরি করার সুযোগ করে দেয়, তবে প্রাপ্ত ক্লোনের জীবিত থাকার হার অনেক কম ও বিভিন্ন জটিলতার সম্মুখীন হয়। এক্ষেত্রে, স্প্যানিশ বকরির ক্লোনিং প্রচেষ্টা সফল হতে পারেনি, কারণ প্রাপ্ত জীবনের দীর্ঘস্থায়িত্ব ও স্বাস্থ্য জটিল ছিল [উৎস: Nature, 1996]。
৩. জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিপ্লব
CRISPR প্রযুক্তির মাধ্যমে বিলুপ্ত প্রজাতির DNA পুনরুদ্ধার করে আধুনিক প্রজাতির সেলে সংশোধন করে পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে প্রথমে প্রাচীন জীবাশ্ম থেকে DNA সংগ্রহ করে তা আধুনিক নেকড়ের DNA এর সাথে তুলনা করা হয়, এবং প্রয়োজনীয় জেনেটিক পরিবর্তন প্রয়োগ করা হয়। তবে, হাজার হাজার বছর পুরানো DNA-এর ক্ষয়পোয়াকা কারণে এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ও জটিল [উৎস: Doudna & Charpentier, 2020]।
নৈতিকতা ও পরিবেশগত প্রশ্ন
একদিকে যখন বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতিতে আমরা বিলুপ্ত প্রাণীকে পুনর্জীবিত করার উচ্চাকাঙ্খার সাক্ষী হচ্ছি, অন্যদিকে মুসলিম নৈতিকতা আমাদের সতর্ক করে দেয় যে, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি আমাদের বিনম্রতা ও দায়বদ্ধতা থাকা উচিত।
وَإِذَا الْوُحُوشُ حُشِرَتْ
“যখন বন্য প্রাণীদের একত্রিত করা হবে” (সূরা তাকভীর ৮১:৫)
পরিবেশগত ভারসাম্য ও বাস্তুসংস্থান
ডায়ার উলফের পুনর্জন্মের ফলে পরিবেশে তার আগের ecological niche ফিরে আসবে কি না—এটি এক জটিল প্রশ্ন। কখনও কখনও মানব হস্তক্ষেপ প্রকৃত বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করে ফেলতে পারে। মুসলিম উম্মাহ বলে, “কাশফ-ই রিজক” অর্থাৎ, প্রতিটি সৃষ্টির পর্যাপ্ত রিজক রয়েছে। তাই, বিলুপ্ত প্রাণীদের পুনর্জীবিত করার প্রক্রিয়ায় আমাদের অবশ্যই সেই নৈতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার চিন্তা রাখতে হবে [উৎস: United Nations Environment Programme, 2019]।
নৈতিক ও সামাজিক দ্বিধা
একদিকে এই প্রচেষ্টা বিজ্ঞানকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে, আবার অন্যদিকে এতে বিনোদনমূলক অথবা শোপিস হিসাবে ব্যবহার করার আশঙ্কাও রয়েছে। যদি আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য শুধুমাত্র দর্শকদের মনোগ্রাহী প্রদর্শনী হয়, তবে আমরা প্রকৃতির সৃষ্টির মহিমা ও তার নৈতিক মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হতে পারি। মুসলিম উম্মাহ এই দিকটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানায়, কারণ প্রকৃতি ও জীবজগতকে আমাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে [উৎস: Colossal Biosciences, 2023]।
উপসংহার
ডায়ার উলফের পুনর্জন্মের প্রচেষ্টা একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির নিদর্শন, অপরদিকে মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার জটিল দ্বন্দ্বের প্রতিবিম্ব। এই গবেষণা ও প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা যেন প্রকৃতিতে আমাদের দায়বদ্ধতা, সততা ও সম্মানের প্রতিফলন ঘটাতে পারি তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের বিনিয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা আজ পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
“বিজ্ঞান যেন ঈমানের সাথে হাত ধরে এগোয়”
তথ্যসূত্র
- Leidy, J. (1858). Fossil Discoveries and the Naming of Canis dirus.
- Nature Journal (2021). Dire Wolf Genomic Analysis: Unraveling the Past.
- BBC News (2019). Quagga Project: Reviving a Lost Species.
- Nature (1996). Cloning Milestone: The Story of Dolly the Sheep.
- Doudna, J., & Charpentier, E. (2020). CRISPR and Genome Editing: The Revolution.
- Colossal Biosciences (2023). Press Release on De-Extinction Initiatives.
- United Nations Environment Programme (2019). Endangered Species Report and Ecological Impact.
NRG ALFA ZONE | Sci-Fi meets Reality